পিএমখালীতে কৃষি জমির উপর সাতটি স্কেবেটরের থাবা : ফলন বিপর্যয়ের শঙ্কা

শাহজাহান চৌধুরী শাহীন, স্টাফ রিপোর্টার, কক্সবাজার।। কক্সবাজার সদর উপজেলার পিএমখালীতে অবাধে কৃষি জমির টপ সয়েল (জমির উপরি ভাগের উর্বরা অংশ) কেটে নেয়া হচ্ছে ইটভাটায়। তাছাড়া বসতভিটা ও পুকুর ভরাট কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে এসব মাটি। ভূমি আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নুরুল হুদা ও মো. আবদুল্লাহর নেতৃত্ব সিন্ডিকেট ফসলি জমির টপ সয়েল কেটে উজাড় করছে। ফলে এলাকার পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি কৃষি উৎপাদন ও ফসল বৈচিত্র্য মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়বে।
সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, সদর উপজেলার পিএমখালী ইউনিয়নের ছনখোলা, চেরাংঘর বাজারজুমছড়ি বিলসহ বিভিন্ন এলাকায় ৭টি স্কেবেটর দিয়ে দিনরাত কৃষি জমির উপরিভাগের উর্বরা অংশ কেটে অর্ধশতাধিক মিনি ট্রাক-ডাম্পারে করে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। আর এসব মাটি যাচ্ছে বিভিন্ন ইটভাটায়। তাছাড়া বসতভিটা ও পুকুর ভরাট কাজেও এঁটেল মাটির ব্যাপক চাহিদা বেড়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মাটি কাটার গভীরতার পরিমাণ ৫ থেকে ১০ ফুট পর্যন্ত ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ফলে কোথাও কোথাও অর্থনৈতিক ও অনৈতিক আগ্রাসনে পার্শ্ববর্তী মালিকের জমিও নষ্ট হচ্ছে। কৃষি জমি রক্ষায় জন্য এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসন বরাবর লিখিত অভিযোগ করেও কোন সুরাহা হয়নি। এরআগে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অভিযান চালিয়ে বেশকয়েক বার জরিমানাও করেছিল। এলাকাবাসী ও বিভিন্ন সুত্রে জানা গেছে, পিএমখালী ইউনিয়নের উত্তর নয়াপাড়ার মো. হোছনের ছেলে আবদুল্লাহ ও মধ্যম নয়াপাড়ার আবু বক্করের ছেলে নুরুল হুদা একটি সিন্ডিকেট গঠন করে পাহাড় ও জমির টপ সয়েল কেটে পাচার করে আসছিল। পিএমখালী এলাকায় ফসলী জমিতে সাতটি স্কেবেটর ও ৫০ টি ডাম্পার দিয়ে অবাধে কৃষি জমির টপ সয়েল পাচার করে আসছে। মাটি ভর্তি প্রতি গাড়ী বিক্রি করা হচ্ছে ৮৫০ টাকায়। এতে জমির মালিক পান গাড়ী প্রতি ১০০ টাকা।দৈনিক প্রতিটি ডাম্পার ২ থেকে আড়াই'শ গাড়ী মাটি বিক্রি করে যাচ্ছে। স্থানীয়রা জানান, নুরুল হুদার মালিকানাধীন রয়েছে ২ টি স্কেবেটর। প্রতিদিন রাতে ও দিনে সমান তালে টপ সয়েল পাচার করায় রাস্তাঘাট ধুলো-বালি হয়ে যায়। এতে সাধারণ মানুষ স্বাভাবিক ভাবে চলাচলে মারাত্মক দূর্যোগে পড়েছে। কৃষি বিজ্ঞানের ভাষায় যে কোনো ফলনযোগ্য জমির উৎপাদন শক্তি জমা থাকে মাটির ৬ থেকে ১৮ ইঞ্চি গভীরতায়। মাটির এই অংশেই যে কোনো ফসল বেড়ে ওঠার গুণাগুণ সুরক্ষিত থাকে। বীজ রোপণের পর এই অংশ থেকেই ফসলটি প্রয়োজনীয় উপাদান গ্রহণ করে। এই অংশটি একবার কেটে নিলে সে জমির আর মৃত্তিকা প্রাণ থাকে না। এমনকি ওই জমিতে ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে কোনো ফসল বেড়ে উঠবে না। এতে জমিটি পরিত্যক্তই হয়ে যায়। সূত্র জানায়, এবারের শুকনো মৌসুমের শুরুতে কক্সবাজার সদর উপজেলা প্রশাসন টপ সয়েল বিক্রি রোধে পিএমখালী এলাকায় অভিযান চালিয়ে আবদুল্লাহকে দুই দফায় ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এর দুইদিন পর গত ২৫ নভেম্বর থেকে পিএমখালী এলাকায়স্কেবেটর দিয়ে জমির টপ সয়েল কেটে পাচার শুরু করেন। কিছুতেই থামছে না মাটি ব্যবসায়ী দুর্বৃত্তদের অপতৎপরতা। ইটভাটা ও বসতভিটায় টপ সয়েলের ব্যাপক চাহিদা থাকায় নুরুল হুদা ও মো. আবদুল্লাহ মাটি খেকো চক্র কৃষকদের (জমির মালিক) বিভিন্ন কৌশলে প্রলুব্ধ করে সামান্য (গাড়ী প্রতি ১' শ টাকা) অর্থের বিনিময়ে তা উজাড় করছে। ফলে কৃষকরা ধরে রাখতে পারছেন না তাদের জমির স্বাভাবিক ফলন। জানা যায়, কৃষি জমির টপ সয়েল কেটে নেয়ার কারণে ফসলের প্রধান খাদ্য নাইট্রোজেন, ফসফরাস, আয়রন, জিংক, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, পটাসিয়ামসহ বিভিন্ন জৈব উপাদানের ব্যাপক ঘাটতি হচ্ছে।
অন্যদিকে, চলাচলে নিষেধ থাকলেও মাটি ভর্তি ভারি ট্রাক, ডাম্পার চলাচল করায় গ্রামীণ রাস্তাঘাট ভেঙে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ইটভাটার তত্ত্ববধায়ক জানান, মাটি ব্যবসায়ীরা তাদের ইটভাটার মাটি সরবরাহ করে থাকে। ভাটা মালিকরা কেউ টপ সয়েল কাটায় সরাসরি জড়িত নয়। এব্যাপারে টপ সয়েল কাটায় সরাসরি জড়িত সিন্ডিকেট প্রধান নুরুল হুদা ও মো. আবদুল্লাহ স্কেবেটর দিয়ে টপ সয়েল বিক্রির কথা স্বীকার করে বলেন, উপজেলা প্রশাসনের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েই ফসলী জমির টপ সয়েল কাটা হচ্ছে। তারা বলেন, সাতটি স্কেবেটরের মধ্যে দুটির মালিক নুরুল হুদা। বাকীগুলো ভাড়ায় চালিত। প্রতিদিন ৫০ টি ডাম্পার গাড়ী মাটি পাচারে জড়িত থাকলেও সব গাড়ী ভাড়ায় চালিত বলে জানান তারা। এব্যাপারে কক্সবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জাকারিয়া বলেন, সাধারণ কৃষকদের অসচেতনতার সুযোগে এক শ্রেণির মাটি ব্যবসায়ীরা কৃষি সম্পদের সর্বনাশ করছে। এ ব্যাপারে মাঠ পরিদর্শন করে শিগগির কৃষকদের বুঝানোর চেষ্টা করা হবে।তিনি আরও জানান, মাটি কাটার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে দফা দফা অভিযান চালানো হয়েছে। জরিমানাও করা হয়েছে ষনেককে।এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।
প্রসংগত, ২৩ নভেম্বর কক্সবাজার সদর উপজেলার পিএমখালি ইউনিয়নের ঘাটকুলিয়া পাড়া এলাকায় কৃষি জমির টপ সয়েল কাটার অপরাধে আব্দুল্লাহ নামের একজনকে ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেয়া হয়েছিল। এর কিছুদিন পর পুনরায় অভিযান চালিয়ে দ্বিতীয় দফায় আরও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছিল।