প্রযুক্তির এই যুগে পিড়িতে বসে এখনও চুল দাড়ি কাটানো যায় ত্রিশ টাকায়

প্রযুক্তির এই যুগে পিড়িতে বসে এখনও চুল দাড়ি কাটানো যায় ত্রিশ টাকায়
ছবি: বিকাশ রায় চৌধুরী

বিকাশ রায় চৌধুরী, স্টাফ রিপোর্টার।। বর্তমান সময়ে শহর-বন্দর হাট-বাজার গুলোতে রয়েছে এসি ও নন-এসি সেলুন ব্যবস্থা। পাশাপাশি রয়েছে পুরুষদের জন্য পার্লারও। আর সে সব সেলুন ও পার্লারে চুল ও দাড়ি কাটার জন্য রয়েছে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও মেশিন। তবে কালক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে ভ্রাম্যমাণ নরসুন্দরদের চুল ও দাড়ি কাটার চিত্র। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অন্য অনেক পেশার মতোই নরসুন্দরের এই পেশা প্রায় বিলুপ্তির পথে। তারপরও গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাজার গুলোতে চোখে পড়ে ভ্রাম্যমাণ নরসুন্দরের চুল ও দাড়ি কাটার দৃশ্য।


ভ্রাম্যমাণ এসব নরসুন্দর চুল কাটার বা ছাঁটার যন্ত্রপাতি নিয়ে বসেন গ্রামের বাজার গুলোতে। হাট-বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে আসা ক্রেতারাই নরসুন্দরদের কাছে চুল দাড়ি কাটায়। সম্প্রতি সরেজমিন ঠাকুরগাঁও জেলার আউলিয়াপুর ইউনিয়নে এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী কচুবাড়ী উপরপরী হাট ঘুরে দেখা যায় নিদিষ্ট একটি স্থানে বসে চুল ও দাড়ি কাটার কাজ করছে নরসুন্দরা। আর চুল ও দাড়ি কাটাতে আসা ব্যক্তিরা পিঁড়িতে বসিয়ে চুল ও দাড়ি কাটছেন। 

নরসুন্দর দমাশুর সাথে কথা বলে জানা যায়, তার বর্তমান বয়স ৫৫ বছর সেই ছোট বেলা থেকে এভাবেই দাড়ি ও চুল কাটছেন। কচুবাড়ী বাজারে সপ্তাহে দুই দিন হাট বসে শুক্রবার ও মঙ্গলবার। আর সোমবার ও বৃহস্পতিবার সালন্দর চৌধুরীহাটে ঠিক এ বাজারের মত পিঁড়িতে বসে চুল ও দাড়ি কাটানোর কাজ করেন তিনি। এ কাজের পাশাপাশি টুকটাক কৃষিকাজও করেন তিনি।  


তিনি আরও জানান, আগের মত বর্তমানে মানুষ আর আমাদের কাছে চুল ও দাড়ি কাটায় না। সপ্তাহে যে টাকা উর্পাজন করি সে টাকা দিয়ে সপ্তাহের বাজার হয় না ঠিকমত। কারন আমার সংসারে সদস্য সংখ্যা একটু বেশি। 
নরসুন্দর পরেশ দৈনিক আজকাল বাংলাকে জানায়, আমার পরিবারে সদস্য সংখ্যা ৭ জন এক ছেলে এক মেয়ে স্কুলে পড়াশোনা করে। সপ্তাহে যা টাকা উর্পাজন করি সে টাকা দিয়ে কাঁচা বাজার ও মুদিখানার দোকানের বাজার হয় কোনমতে। পাশাপাশি কৃষি কাজ করি বলে সংসার চালাতে পারি। ভগবানের কৃপায় সংসার চলে যাচ্ছে।
তিনি আরও জানায়, মাঝে মধ্যে বিয়ের অনুষ্ঠানের কাজ করলে উর্পাজন ভাল হয়। এ মাসে তো বিয়ের অনুষ্ঠান নেই কারন চৈত্র মাসে আমাদের সম্প্রদায়ের বিয়ের অনুষ্ঠান হয় না। তবে পহেলা বৈশাখ ও ঈদ এর জন্য আগের তুলনায় উর্পাজন একটু বেশি হচ্ছে। 


এই দুই বাজারের মত গড়েয়া বাজার, তুরুকপথা বাজার, ডিহাট বাজার সহ আরও অনেক বাজারে নরসুন্দরদের খোলা আকাশের নিচে বসে চুল ও দাড়ি কাটতে দেখা যায়। আর এভাবেই যুগের পর যুগ  চুল ও দাড়ি কেটে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন তারা। তারা চুল ও দাঁড়ি কাটতে ২০-৩০ টাকা নেন।  আর শেভ বা দাড়ি ঠিক করতে ১৫-২০ টাকা নেন।


আউলিয়াপুর ইউনিয়নের সরকার পাড়া থেকে হাটে আসা দিনেশ রায় বলেন, ‘ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে হাটে এসে এই ভ্রাম্যমাণ নরসুন্দরদের কাছে চুল কাটাতাম। এখন আমি আমার সন্তানদের এনে চুল কাটাচ্ছি।’


তিনি আরও বলেন, ‘আমি রাজমিস্ত্রীর কাজ করি। সেলুনে চুল ও দাড়ি কাটাতে গেলে ৫০ থেকে ৮০ টাকা লাগে। আর এদের কাছে মাত্র ২০ থেকে ৩০ টাকায় চুল ও দাঁড়ি কাটানো যায়। সেলুন আর এদের কাজের মান প্রায় সমান।’
একই ইউনিয়নের সাসলা পিয়ালা এলাকার মকবুল ইসলাম বলেন, আমাদের এলাকার বেশিরভাগ মানুষই ভ্রাম্যমাণ এই নরসুন্দরদের দিয়ে চুল-দাড়ি কাটান। তাদের কাছে অনেক কম টাকায় চুল-দাড়ি কাটানো যায়।


নরসুন্দর কদুশর্মা বলেন, ‘এ পেশা আমার দাদার ছিল। দাদার মারা যাওয়ার পরে বাবাও ছিলেন এ পেশায়। বাবার কাছ থেকেই আমার আমি কাজ শিখেছি। বর্তমানে বাবা বেঁচে নাই আমি হাল ধরেছি। টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছি।’
তিনি আরও বলেন, উপরপরীহাটে সপ্তাহে দুদিন হাট বসে। প্রতি হাটে চুল ও দাড়ি কেটে ৩০০-৪০০ টাকা আয় হয়। সালন্দর চৌধুরী হাটে সপ্তাহে দুই দিন হাট বসে সে হাটে এ বাজারের থেকে উর্পাজন ভাল হয়। এ আয় দিয়েই সংসার চলেনা পাশাপাশি বাড়িতে ধান ও শাকসবজি চাষাবাদ করে দিন পার করছি।


ঠাকুরগাঁও জেলা নরসুন্দর সমিতির সভাপতি শ্রী কেশব শর্মা বলেন, ভ্রাম্যমাণ নরসুন্দরদের সেলুন এর দোকান নেই। তাই তারা হাট-বাজারে খোলা আকাশের নিচে পিঁড়িতে বসে মানুষদের চুল ও দাড়ি কাটেন। তারা সামান্য পুঁজি খাটান বলে ২০-৩০ টাকার মধ্যে চুল ও দাঁড়ি কেটে দিতে পারেন।