পশ্চিমবঙ্গের কবি অঞ্জন মন্ডলের কবিতা 'গাঁয়ের স্মৃতি'

পশ্চিমবঙ্গের কবি অঞ্জন মন্ডলের কবিতা 'গাঁয়ের স্মৃতি'
কবি অঞ্জন মন্ডল/ছবি: সংগৃহীত

গাঁয়ের স্মৃতি
অঞ্জন মন্ডল

বলতে পার কেমন আছে আমার প্রিয় গ্রাম?
খুলনা জেলার দক্ষিণে যার সুতারখালী নাম৷
শ্রীনগরের গ্রাম ছাড়িয়ে ফরেস্ট অফিস বামে
রামনগরের ঘাট পেরিয়ে সবাই যেথায় নামে—
সেইতো আমার গাঁয়ের শুরু ভদ্রা নদীর পার
আর পারে তার সুন্দরী বন বিশ্বে খ্যাতি যার৷
পথের পাশে গাছের সারি ডাইনে সবুজ মাঠ
একটু গেলেই সামনে পাবে তেলীখালীর হাট৷
বুধবারে সেই সকাল থেকে দীর্ঘ সাঁঝের বেলা 
হাটটি জুড়ে দেখবে তুমি সে এক মিলন মেলা৷
ভদ্রা হেথায় বাঁক নিয়েছে ভাঙার খেলা খেলে
অতীত সকল লোকবসতির চিহ্ন মুছে ফেলে৷
পথিকজনার পায়ের সাথে দিক মিলিয়ে শেষে
চারটি পাড়ার পথ মিলেছে এই বাঁকেতে এসে।
হাটের কাছে তেলীর বাড়ি মধ্যে খানিক ফাঁকা
ঘরের পরে ঘর সাজানো সবুজ ছায়ায় ঢাকা৷
দুই পাশেতে মোড়ল বাড়ি বৈষ্ণবেদের ঘেঁষে
মধ্যে যে তার বৈদ্য বাড়ি ঘরামি সব শেষে৷
পশ্চিমে দূর মাঠের পারে কেওড়াতলী পাড়া
দখিন দিকে রায়-মাঝিরা একটু ছাড়া ছাড়া৷
এর মাঝেতে বসত করে মীর, গাজী ও সানা
সব মিলিয়ে স্বর্গ যেন আমার সে গ্রামখানা৷

ভাগ্যদোষে আজকে আমি অনেকখানি দূরে
মনটা যে তাই স্মৃতির দেশে বেড়ায় ঘুরে ঘুরে৷
কেউ কি আছো দূর বা কাছের বন্ধুজনা খাঁটি
বলতে পার কেমন আছে আমার মাটির 'মা'টি?
কেমন আছে যাদের সাথে আমার ছিল বাস
মন্দ-ভালোয় কাটছে সবার তেমনি বার মাস?
কেমন আছে ছোট্ট বেলার খেলার সাথী যত
তারাও ভাবে আমার কথা এমনি আমার মত!
তেমনি আছে সকল কিছু যেমনি ছিল আগে?
সব কিছু তার জানতে বড়ই ইচ্ছে মনে জাগে।

বিনোদ বাবুর বাড়ীর কাছে তালদীঘিটার পাড়
আজও আছে তেমনি ঠাসা বুনো কুলের ঝাড়?
হয় কি সেথায় আগের মত তেমনি কালীপূজা
ভোর না হতেই সবাই ছোটে দেখতে চতুর্ভূজা?
চণ্ডীবুড়ির আমকাঁঠালের সেই যে বাগানখানি
পাড়ার যত কিশোরদলে দেয় সেকি হাতছানি?
তেমনি আজও ঘরামিদের বসত ভিটের পরে
হয় কি বিশাল দূর্গা পূজা আগের মতন করে?
তেমনি কিগো অষ্টমী পার ঠিক নবমীর রাতে
পাড়ার লোকে সবাই মিলে যাত্রা গানে মাতে!

তেমনি কিগো নদীর বুকে অচিন দেশের নেয়ে 
পাল তুলে যায় দূর অজানায় ভাটিয়ালী গেয়ে?
নৌকা চড়ে নদীর মাঝে বড়শি-দোয়ান ফেলে
ব্যস্ত হাতে ছাঁকনি ধরে কাঁকড়া তোলে জেলে?
তেমনি করে জেলের দলে থাকতে গাঙে ভাটা
দু'কুল ঘিরে ঝোরার মুখে বসায় কি চর-পাটা?
তেমনি আছে বা'রচরেতে কেওড়া-ওড়ার বন
বাইন ফুলের মধুর সুবাস নেয় কি কেড়ে মন?
সন্ধ্যা হতেই দূর বাদাড়ে তেমনি থেকে থেকে
শিয়ালগুলো হুক্কা হুয়া যায় কি ডেকে ডেকে?

তেমনি আজও বর্ষা কালে সাত সকালে উঠে
চাষার দলে লাঙল কাঁধে যায় কি মাঠে ছুটে?
তেমনি কিগো নদীর চরে রাখাল ছেলের দল-
চরায় গরু ঝোপের তলে খোঁজে কি কাউফল?
কার গরু কার পড়ল ক্ষেতে এ সব কথা ভুলি'
দামালগুলো পথ জুড়ে সব খেলে কি ডাঙ্গুলি?
শাপলা ভরা বদ্ধ খালে তেমনি কি খাপ ফেলে
ডিঙ্গি চেপে মাছ ধরে সেই খাঁ সাহেবের ছেলে?
বলতে পার আজও আছে আলেক দাদু বেঁচে,
তেমনি বুড়ো মাছ ধরে কি কেওড়াতলী সেঁচে?

শীতের চাদর গায় জড়িয়ে আসলে কি অঘ্রান
চাষার দলে তেমনি চলে কাটতে সোনার ধান?
সন্ধ্যেবেলা ধানের বোঝা সাপটে মাথায় করে
সার বেঁধে সব ঘরে ফেরে আলটানা পথ ধরে।
ঘুম জড়ানো ক্লান্ত চোখে মোরগ ডাকা ভোরে-
গরুর পায়ে ধান মলে রোজ দেমনগাঁথা করে?
ঘোর কুয়াশায় তেমনি কেহ লাফায় ধরে মাছ'
ঠুঙ্গি বেঁধে শিউলি আজও কাটে খেজুর গাছ?
গুড় বানাতে ব্যস্ত সে কি, সামলাতে জ্বাল বউ
নতুন গুড়ের সুবাস মেখে বাতাস কি মউ মউ?
 
এমনি কত হাজার স্মৃতি মনের কোণে জাগে
জীবনপথে আধেক এসেও বড্ড একা লাগে।
ছুটছে জীবন ব্যস্ত তবু সকল কাজের ফাঁকে
অতীত যেন আমায় সদা হাত বাড়িয়ে ডাকে।
সেই শ্রীময়ী রূপটি তারি বারেক দেখার তরে
মনপাখি যে বুকের খাঁচায় হাঁসফাঁসিয়ে মরে।
বিদায় বেলায় একটা শুধু আর কিছু না চাই
শেষের দিনে ঐ মাটিতেই পাই যেন গো ঠাঁই।

কবিতাটিতে কয়েকটি আঞ্চলিক (দক্ষিণ খুলনার) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। তার অর্থ নিন্মরূপ-
দোয়ান>দোন--লম্বা দড়ির বা মোটা সুতোর মাঝে ৩-৪ ফুট দূরত্বে বড়শিবাঁধা সুতো বেঁধে বড়শিতে টোপ গেঁথে মাছ ধরার জন্য জলের সমতলে লম্বা করে দণ্ডের সাহায্যে ঝুলিয়ে রাখা হয় আর কাঁকড়া ধরার জন্য জলের নিচে ডুবিয়ে দেয়া হয়। ঝোরা>ঝরণা--খালের সরু প্রান্তভাগ। বা'রচর>বাহির চর--চরের বহির্ভাগ। চর-পাটা--এক ধরণের দীর্ঘ জাল যার নিন্মভাগ নদীতে ভাটা অবস্থায় চলে পুঁতে রাখা হয় শেষ জোয়ারে অপর প্রান্ত উঁচু করে দন্ডের সাথে বেঁধে দেয়া হয়। কেওড়া, ওড়া, বাইন--সুন্দর বনের গাছ। কাউফল--সুন্দরবন অঞ্চলের এক রকম লতা জাতীয় উদ্ভিদের ত্রিপলা ফল। মলে--মাড়াই করে। দেমন--গরুগুলোকে এক সারিতে পাশাপাশি বাঁধার জন্য বিশেষ ভাবে তৈরি দড়ি বিশেষ। লাফা--সরু খালের মাঝে আড়াআড়ি ভাবে ঘাস, বিচুলি জল সমান করে বিছিয়ে তার উপর কাদামাটি লেপে সমান করে জলের পাশগুলো কলার খোল দিয়ে আঁটকে দেয়া হয় ।এর ভিতরে মাছ লাফিয়ে উঠলে আর বেরোতে পারে না। ঠুঙ্গি>ঠুঙি--গাছিদের খিল, গোঁজ দা প্রভৃতি রাখার বাঁশের তৈরি ঠোঙা বিশেষ।