নিজস্ব প্রতিবেদক,ঢাকা : দশম শ্রেণির ছাত্র শাকিল (১৭)। ছোটবেলায় মারা যায় তার বাবা। অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা,নিজের ও ছোট ভাইয়ের পড়াশোনা ও সংসারের খরচ মেটাতে বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত ইজিবাইক চালাতো শাকিল। কিন্তু সংসারের হাল ধরা ইজিবাইকই কাল হলো তার। মদের পার্টির টাকার জন্য শাকিলকে হত্যার পর ইজিবাইক ছিনতাই করে কিশোর গ্যাং সদ্যরা। হত্যার পর ইজিবাইক বিক্রি করে মদের পার্টি করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা।
মেধাবী ছাত্র ইজিবাইকচালক শাকিল হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন, হত্যাকাণ্ডে জড়িত ৪ আসামি গ্রেফতার ও হত্যায় ব্যবহৃত রক্তমাখা চাকু ও অন্যান্য আলামত উদ্ধার করেছে পুলিশ।
গ্রেফতারকৃতরা হলেন, জনি (২০), শারাফাত (২০), ইব্রাহিম চান (২১) ও সাব্বির হোসেন মেহেদী (২২)।
রোববার (২১ মে) দুপুরে নিজ কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মো.আসাদুজ্জামান।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, গত ১৯ মে সকাল ৬টার দিকে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানাধীন মঠবাড়ী পদ্মা রেলওয়ে সেতুর নিচে পরিত্যক্ত ইটের খোলার ভেতরে একজনের গলাকাঁটা লাশের খবর পায় দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জ থানা পুলিশ। প্রাথমিকভাবে জানা যায়, মৃতদেহটি একই ইউনিয়নের পালিরা গ্রামের মৃত সিদ্দিক মিয়ার ছেলে শাকিলের (১৭)। ঘটনাস্থলে উপস্থিত শাকিলের পরিবারের সদস্যরা মৃতদেহটি শাকিলের বলে শনাক্ত করে।
নিহত শাকিলের পরিবার জানায়, শাকিল দশম শ্রেণির ছাত্র, তার বাবা ছোটবেলায় মারা যায়। বাসায় শাকিল তার অসুস্থ মা ও ছোট ভাইকে নিয়ে থাকতো। নিজের পড়াশুনা, মায়ের চিকিৎসা ও সংসারের খরচ মেটাতে শাকিল স্কুল শেষে প্রতিদিন বিকেল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ইজিবাইক চালাতো।
প্রতিদিনের মতো শাকিল গত ১৮ মে বিকেলে ইজিবাইক নিয়ে বের হয়। অনেক রাত হয়ে হলেও সে বাসায় আসে না। পরদিন সকালে তার মরদেহ উদ্ধার হয়।
ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, পুলিশ মৃতদেহের সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুত করার সময় দেখতে পায়, ধারালো অস্ত্র দিয়ে মাথা থেকে দেহ প্রায় বিচ্ছিন্ন করা। পিঠে ১১টি এলোপাথাড়ি চাকুর ক্ষত এবং পেটে চাকু মারায় নাড়িভুড়ি বের হয়ে যায়। সুরতহাল শেষে পুলিশ শাকিলের মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালে প্রেরণ করে।
এ ঘটনায় পরবর্তীতে শাকিলের বড় বোন মোছা. সীমা বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার পরে ঢাকা জেলা পুলিশের কর্মকর্তারা মাঠে পুংখানুপুঙ্গু তদন্ত শুরু করে।
পুলিশ ধারণা করে, আসামিরা ইজিবাইক ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে শাকিলকে নির্জন পরিত্যক্ত ইটখোলায় নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। তদন্ত টিম ঘটনাস্থল ও এর আশেপাশের এলাকায় তথ্য-প্রযুক্তির সর্বোত্তম প্রয়োগ করে হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের শনাক্ত করতে সক্ষম হয়।
প্রযুক্তিগত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, আসামিরা তাদের মোবাইল বন্ধ করে বিভিন্ন জেলায় পালিয়ে গেছে। প্রায় টানা ২৪ ঘণ্টা ধারাবাহিক অভিযান পরিচালনা করে হত্যাকাণ্ডে জড়িত আসামিদের গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার সবাই মাদকাসক্ত এবং কিশোর গ্যাংয়ের সক্রিয় সদস্য।
হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত একটি রক্তমাখা সুইসগিয়ার, আসামিদের ব্যবহৃত রক্তমাখা সিএনজি ও লুন্ঠিত ইজিবাইকটি পুলিশ উদ্ধার করে।
আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার জানান, গত ১৮ মে আসামিরা একটি ইজিবাইক ছিনতাই করে ব্যাটারি বিক্রির টাকা দিয়ে মদের পার্টি করবে বলে পরিকল্পনা করে। সেই পরিকল্পনা মোতাবেক ওইদিন সন্ধ্যায় একটি সিএনজি ভাড়া নিয়ে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের কাউচাইল ঘাটে টার্গেট ইজিবাইকের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। পরবর্তীতে কোনো ইজিবাইক না পেয়ে গ্রেফতার শরাফত ও জনি কাটাল ঘাট এলাকা থেকে সামনে এগিয়ে গিয়ে শাকিলকে পায়।
আসাদুজ্জামান আরও বলেন, নিহত শাকিল গ্রেফতার জনির পূর্ব পরিচিত হওয়ায় শাকিলকে নির্জন জায়গায় ভাড়া করে নিয়ে যাওয়া সহজ হবে মনে করে শাকিলের ইজিবাইক ভাড়া করে। জনি, শরাফাত এবং সাব্বির শাকিলের ইজিবাইকে উঠে ঘুরতে ঘুরতে শাকিলকে নিয়ে মঠবাড়ী পরিত্যক্ত ইটখোলায় যায়।
অন্যদিকে ইব্রাহিম সিএনজি নিয়ে তাদের পিছু পিছু আসে। এরপর ঘটনাস্থলে পৌঁছানো মাত্রই পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক শারাফাত সুযোগ বুঝে সুইসগিয়ার দিয়ে শাকিলের গলায় পোচ দেয়। এতে শাকিল ইজিবাইক থেকে পড়ে গিয়ে গলা চেপে ধরে চিৎকার শুরু করে।
তখন জনি পেছন থেকে শাকিলের পিঠে এলোপাথাড়ি চাকু মারতে থাকে। কিন্তু তারপরও শাকিল চিৎকার ও দাপাদাপি করতে থাকলে জনি, সাব্বির এবং ইব্রাহিম চান শাকিলের মাথা ও হাত-পা চেপে ধরে। শরাফাত শাকিলকে সুইসগিয়ার দিয়ে মাথার সামনে-পেছনে জবাই করে মাথা প্রায় বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।
পুলিশের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, মৃত্যু নিশ্চিত করার পর শরাফত, জনি ও ইব্রাহিম সিএনজিতে করে চলে যায়। আসামিরা মদের পার্টির টাকার জন্য পূর্ব পরিচিত ইজিবাইকচালক শাকিলকে হত্যার পর ইজিবাইক ছিনতাই করে।